keyboard_arrow_up
keyboard_arrow_down
keyboard_arrow_left
keyboard_arrow_right

অতিমারীর কালকক্ষ: এক রূপকথা ও আমি

Start Reading

*** এই লেখাটি শারদীয়া পেখম ১৪৩০ (ইংরেজি বছর ২০২৩) পুজো সংখ্যাতে প্রকাশ পেয়েছিল।

 

শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা হিসেবে কালকক্ষর ৬৯তম জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তি হয়তো বাংলা সিনেমার ইতিহাসে একটা মাইলফলক। কালকক্ষর এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথ ও সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে আমার এই যাত্রায় জড়িয়ে যাওয়া রূপকথার চেয়ে কোনো অংশে কম না।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে যখনই কোনো সংকটকাল উপস্থিত হয়েছে, সেই সময়ের বুক থেকেই কালজয়ী সব শিল্পের সৃষ্টি- সে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা বা সিনেমা যাই হোক না কেন। কালকক্ষর সৃষ্টিও এমনই এক বিনাশকালের গর্ভ থেকেই।

 

২০২০ সালের মার্চ মাস। বিগত বেশ কিছু মাস ধরে আমরা অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশনের প্রযোজনায় এবং রাজদীপ পাল ও শর্মিষ্ঠা মাইতির পরিচালনায় অন্য একটা সিনেমার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সেটাই হতো আমাদের ডেবিউ ফিল্ম। বেশ তোড়জোড় করে প্রস্তুতি, অভিনেতাদের সাথে রিহার্সাল চলছিল। মে/জুন মাস নাগাদ শুটে যাওয়ার প্ল্যান ছিল। এইরকম সময়েই এসে গেল মহামারী আর তার পিছনে পিছনে লকডাউন। ফলে আমাদের সমস্ত কাজ বন্ধ রেখে গৃহবন্দী হতে বাধ্য হতে হল। আমরা আশায় ছিলাম যে শীঘ্র সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে এবং আমরাও বাকি কাজ সেরে জলদি শুটে নামতে পারবো। কিন্তু যত দিন যায় আমরা বুঝতে পারি যে বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সিনেমা আর সম্ভব না। সেই সময় মনে হয়েছিল হয়তো কোনোদিনই আর কোনো কিছুই সম্ভব না। একটা সময়ে অফিসিয়ালি কাজটা বন্ধ করা হয়। ফলে আমরা কম বেশি সবাই সংশয়, হতাশায় ডুবে যাই। এই হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্যেই প্রতিটা দিনের বাঁচা মরার লড়াই আর গভীর জীবনবোধ থেকে ধীরে ধীরে রাজদীপদা, শর্মিষ্ঠাদি কালকক্ষর কনসেপ্ট ভাবে এবং গল্পটা লেখে। সম্ভবত জুলাই মাসে একদিন রাজদীপদা ও শর্মিষ্ঠাদি আমাদের প্রযোজক অঞ্জনদা ও আমাকে কনফারেন্স কলে কালকক্ষর গল্পটা শোনায়। আমরা চারজন তখন চারটে আলাদা জায়গায় বসে। এই চারজনের মধ্যে সম্ভবত আমি সেইসময়ে একটু বেশি হতাশাগ্রস্ত ছিলাম। কিন্তু কালকক্ষর গল্পটা শোনার সাথে সাথে আমি যেন আবার আশার আলো দেখতে পাই। এক অদ্ভুত প্রাণশক্তি যেন আমার মধ্যে ফিরে আসতে থাকে। গল্প শুনে অঞ্জনদা বলেছিলেন “আমাকে একটু ভাবতে সময় দাও”। কনফারেন্স কলের পরে পরেই আমি আবার রাজদীপদা, শর্মিষ্ঠাদি কে ফোন করি আর আমার ফিডব্যাক জানাই। আমি গল্প শোনার পর থেকেই ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম । আবার মনে একটা আশঙ্কাও ছিল যে ফোনে তো অঞ্জনদার রিয়াকশন বুঝতে পারলাম না। কালকক্ষর মধ্যে যে ধরনের সিনেমার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে সেই সিনেমা ভারতবর্ষে সচরাচর হতে দেখি না। অরোরার দীর্ঘ ৪৫ বছর পরে সক্রিয় ফিচার ফিল্ম প্রযোজনায় কামব্যাক হবে এইরকম একটা ব্যতিক্রমী, প্রচন্ড ঝুঁকিসম্পন্ন ফিল্ম দিয়ে এটা অঞ্জন দা মেনে নেবেন কিনা সেই নিয়ে পরিচালকদের এবং আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। আমাদের সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে ১৫ মিনিট পরেই অঞ্জনদা জানালেন যে এই সিনেমা হচ্ছে। সেই কালকক্ষর পথচলা শুরু।

 

শুরু তো হলো। কিন্তু আমরা সবাই জানতাম ওইরকম এক মহামারীর সময়ে হাজার বিধিনিষেধের মধ্যে এইরকম একটা সিনেমার প্রস্তুতি ও তার শুটিং সহজ হবে না। অভিনেতা নির্বাচনও ভীষণ কঠিন ছিল। আমাদের দরকারের মধ্যে ছিল একটা বাচ্ছা মেয়ে ও এক বয়স্কা মহিলা, যারা সেইসময় করোনার প্রেক্ষিতে সবথেকে ঝুঁকিসম্পন্ন ছিলেন। পরিচালকেরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে অভিনেতাদের বেছে নেয়, তাদের রাজি করায়। সবার প্রথমে অহনা, যে ছোটো মামণির চরিত্রে অভিনয় করেছে তাকে অনেক সাধ্যসাধনায় রাজি করানো হয়। আমার মনে হয় অহনা ও বাদবাকি অভিনেতারা পরিচালকদের প্যাশন, অদ্ভুত জীবনীশক্তি, কালকক্ষর একটা অমোঘ টান, এর সিনেমা হিসেবে সম্ভাবনা এবং অরোরার উপর ভরসা করেই নিজেদের পরিচালকদের হাতে, কালকক্ষে নিজেদের সঁপে দিয়েছিলেন।

 

ঘরে বসেই প্রস্তুতি শুরু হয় সেই জুলাই থেকেই। সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাস থেকে পুরোদমে মাঠে নেমে আমাদের সবকিছু চালু হয়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নয়াবাদে প্রায় জনশূন্য একটা জায়গায় কালকক্ষর জন্য যে ধরনের বাড়ি চাইছিলাম সেটা পাওয়া যায়। সমস্ত রকম বিধিনিষেধ, সামাজিক দূরত্ব মেনেই আমরা, মানে রাজদীপদা, শর্মিষ্ঠাদি, আমাদের এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার প্রতীক, আর্ট ডিরেক্টর সুজিত এবং আমি গোটা কলকাতা চষে ফেলে অভিনেতাদের কস্টিউম এর কাপড় কেনা, সেগুলো মাপমত বানানো, শুটের বাড়িটাকে কালকক্ষর বাড়ি হিসেবে তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিসপত্র খোঁজা, জোগাড় করা ও কেনাকাটা ইত্যাদি করতে থাকি। কিছু ফার্নিচার বানানো হয়, কিছু কেনা হয় আর বাকি ফার্নিচার এক মাসের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়। কালকক্ষ বাড়ির অনেক জিনিসপত্র, পুতুল, বই, চাদর ইত্যাদি কিন্তু দুই পরিচালকের বাড়ি থেকেই অনেকটা সংগ্রহ করা হয় কারণ অন্যত্র কোথাও মনোমত সেগুলো পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রোডাকশন ডিজাইন এর দায়িত্ব রাজদীপদা, শর্মিষ্ঠাদি ও আমি যৌথভাবে পালন করি।

 

কালকক্ষ শুটের যে বাড়ি ফাইনাল হল অনেকটা তার মতোই ভিতরের স্পেস কিন্তু ছোটো অন্য একটা ফ্ল্যাট আমরা তিন মাসের জন্য ভাড়া নিলাম যাতে সেখানে নির্বিঘ্নে আমাদের অভিনেতাদের নিয়ে রিহার্সাল করা যায় এবং শুটের আগে উপরোক্ত সব জিনিসপত্র সেখানে রাখা যায়। সুজিত ও তার সহযোগী বিক্রম আর্ট ডিরেকশন এর সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে সেখানেই থাকা শুরু করল। কালকক্ষতে তিন দেবীর যে মুখ দেখা যায় সেটার প্ল্যান আর ডিজাইন করেছিল রাজদীপদা। সেটার ছাঁচ সুজিত তার শহর বহরমপুর থেকে বানিয়ে এনেছিল। তারপর এখানে এসে নিজে তার ফিনিশিং দেয়। ফ্ল্যাটে নিয়মিত রিহার্সাল চলতে থাকে। এর ফাঁকে ফাঁকে কখনো রাজদীপদার বাড়ি, কখনো শর্মিষ্ঠাদির বাড়িতে আমরা তিনজন স্ক্রিপ্ট ডিসকাশন, স্ক্রিপ্ট এর ঘষামজা করা, শট ডিভিশন, শুটিং প্ল্যান, স্টোরিবোর্ড ইত্যাদি কাজগুলো চালিয়ে যেতে থাকি। প্রচুর সময় নিয়েই আমরা এই কাজগুলো করেছিলাম। যখনই বসতাম তিন চারদিন এর এক একটা স্পেলে প্রায় সারাদিন ধরে কাজ করতে থাকি। একটা সিনেমা ঠিকভাবে বানানোর আগে এই প্রি - প্রোডাকশন ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কালকক্ষ আজ যে সিনেমা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে এই দিনগুলোর অনেক অবদান আছে। খুব সুন্দরভাবে আমাদের স্টোরিবোর্ড করা হয়েছিল। রাজদীপ দা নিজে স্টোরিবোর্ডের ছবিগুলো এঁকেছিল। আমার বিশ্বাস কালকক্ষর স্টোরিবোর্ড কোনোদিন বই হিসেবে বেরোলে সিনেমার ছাত্র ও সিনেমাপ্রেমী মানুষদের ভীষণ উপকারে আসবে। অবশ্য স্টোরিবোর্ড যখন প্রিন্ট করে বাঁধাই হয়ে আসে সেটা প্রায় একটা বই এর মতই লাগছিল। আমার তো এটা গ্রাফিক নভেল মনে হয়েছিল। এই গ্রাফিক নভেলসম স্টোরিবোর্ড শুটের আগে, শুটের সময় আমাদের প্রত্যেকের ভীষণ উপকারে এসেছিল। এইসব আলোচনা, খাওয়া দাওয়া, রিহার্সাল, কেনাকাটা, প্রত্যেকের নিজস্ব প্ল্যানিং আর হাজারটা সামাজিক বিধিনিষেধ এইসবের মধ্যে দিয়েই শুটের আগে সবার মধ্যে একটা টিম স্পিরিট তৈরি হয়।

 

ডিসেম্বর মাসে ঠান্ডার মধ্যে আমাদের শুটিং শুরু হয়। যাতে কারোর কোনো অসুবিধে না হয় তাই শুটেও আমরা যতটা পেরেছি সামাজিক বিধিনিষেধ মেনেই কাজ করেছি। সেইভাবেই আমাদের বাকি টেকনিশিয়ান টিম নির্বাচন করা হয়। তাদেরকে পরিস্থিতি বোঝানো হয়। তারাও ভীষণভাবে সবকিছু মেনে চলেছিল। আমরা নির্দিষ্ট গাড়িতে শুটে যেতাম, সেই গাড়িতেই শুটের শেষে বাড়ি। মাঝে ছুটির দিনগুলোতেও আমাদের টেকনিশিয়ান টিম বাইরে আর কোথাও কোনো কাজ করে নি বা কোথাও যায় নি। মাস্ক পরে ও জিনিসপত্র বারবার স্যানিটাইজ করে শুটিং এর মত পরিশ্রমের কাজ করা খুব কষ্টদায়ক। তবুও, অভিনেতাদের কথা ভেবে, বাকিদের কথা ভেবে আর সিনেমাটা যাতে নির্বিঘ্নে শেষ হতে পারে তার জন্য আমরা সব দুঃখ কষ্ট মেনে নিয়েছিলাম। 

 

সিনেমা তো একটা টিমওয়ার্ক। টিমের সবাইকে, বিশেষ করে অন্য টেকনিশিয়ানদের যারা হয়তো শুটের দিন বা তার দু একদিন আগে জয়েন করে, তাদের যদি যদি প্রসেসটার সাথে, গল্পটার সাথে জড়িয়ে না নেওয়া যায় বা তারা নিজেরাও যদি জড়িয়ে যেতে না পারে তাহলে সেই কাজের স্মৃতি খুব একটা ভালো হয় না এবং তার প্রভাব সিনেমাটার উপরেও ভীষণভাবে পড়ে। এটা আমি বা আমার পরিচালকেরা ভীষণভাবে বিশ্বাস করি। তাই কালকক্ষ শুটের প্রথমদিনই আমরা সবাইকে এক জায়গায় ডেকে তাদেরকে কালকক্ষর গল্পটা বলি এবং শুট কঠিন হবে, কিন্তু, আমাদের সুস্থ থেকে একসাথেই এটা করতে হবে এবং আমরা পারবো এই বিশ্বাস তাদের দি। লাইট বয়, ক্যামেরা কেয়ারটেকার, আর্ট সেটিং, স্পট বয় ইত্যাদি মিলিয়ে আমাদের যে টেকনিশিয়ান টিম ছিল তাদের কালকক্ষে একাত্ম করতে যদিও আমাদের বিশেষ বেগ পেতে হয় নি। এদের অনেকের সাথেই আমাদের কারোর না কারোর কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল।

 

কিন্তু, এইসব সত্বেও শুরুতে তারা আমাদের কাজকর্ম দেখে আমাদের উপর একটু সন্দিহান ছিল। কারণ প্রথম দু–তিন দিন ধরে তারা দেখছে যে আমরা প্রায় একই সিন, এক ধরনের সংলাপ, একই শট কখনো এক ভাবে কখনো জায়গা চেঞ্জ করে নিয়ে যাচ্ছি। চেঞ্জ হচ্ছে কই? কালকক্ষর গল্প যে সাতটা পর্যায়ে লুপের মত চলতে থাকে এবং এই ধরনের গল্প শুট করতে গেলে যেভাবে করতে হয় বা আমরা যেভাবে করতে চাইছি এই জিনিসটার সাথে তারা অভ্যস্ত ছিল না। তাদের অভিজ্ঞতায় অন্য কোনো শুটেও এটা তারা দেখেনি। ফলে, সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনেই আমাকে লাইট বয়েজ, ক্যামেরা কেয়ারটেকারদের অনেকে আলাদা ডেকে জিজ্ঞেস করে যে কেন আমরা এক জিনিস দুই তিনদিন ধরে বারবার শুট করছি। কোথাও কিছু ভুল হলে বা পরিচালকদের পছন্দ না হলে যেমন আমরা পরবর্তী কোনোদিন “রি শুট” করে থাকি এটা সেরকম কিছু হচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করে। তখন আমি এবং রাজদীপদা, শর্মিষ্ঠাদি সবাই তাদের আশ্বস্ত করি যে এটা রি শুটের ব্যাপার বা ভুলভ্রান্তি না। লুপ ভিত্তিক এই গল্প শুটের টেকনিক্যালিটিজ তাদের ভালো করে তখন বোঝানো হয়। এই বোঝাতে আমাদের সেই গ্রাফিক নভেলসম স্টোরিবোর্ড ভীষণ কাজে আসে। এরপর থেকে দেখি দুটো শটের মাঝে ফাঁকা সময়ে বা লাঞ্চ ব্রেকে লাইট বয়, ক্যামেরা কেয়ারটেকার, আর্ট সেটিং এমনকি স্পট বয় পর্যন্ত যে যেমন সময় পাচ্ছে স্টোরিবোর্ডের বইটা পড়ছে। এটা পড়ার ফলে সমস্ত বিষয়টা তাদের কাছে জলের মত স্বচ্ছ হয়। এতটাই স্বচ্ছ হলো যে ছবিতে যা আঁকা আছে তার থেকে একচুল এদিক ওদিক আমি ফ্রেম করলে বা অভিনেতাদের পজিশন চেঞ্জ হলেই তারা আমাদের মনে করিয়ে দিত যে আমরা কিন্তু স্টোরিবোর্ড “ব্রেক” করছি। আর সেটা করলে লুপ নাকি সব গন্ডগোল হয়ে যাবে! তখন আবার তাদের কারণ বুঝিয়ে বলতে হতো। সে এক ঝকমারি, কিন্তু মজার ব্যাপার ছিল। কিন্তু এর ফলে টিমের প্রত্যেকের কাছেই সিনেমাটা কেমন হতে যাচ্ছে আর কার কী করণীয় এটা একদম পরিষ্কার ছিল। খুব ছোট্ট টিম ছিল আমাদের। প্রত্যেকেই মাল্টিটাস্কিং করেছিলাম। একে অপরের কাজে যে যেমন পেরেছি সাহায্য করেছিলাম। কারোর মধ্যে কোনোরকম ইগো বোধ কাজ করেনি। এইটা কালকক্ষ টিমের একটা বড়ো শক্তি ও গর্বের বিষয় ছিল। লোকবল কম থাকায় আমার একমাত্র অ্যাসিস্ট্যান্ট কাম ফোকাস পুলার সৈকত ও আমি যখন যেমন পারতাম আমাদের ক্যামেরা, লাইট, আর্ট টিমের কাজে সাহায্য করে দিতাম। তেমনি লাইট টিম, ক্যামেরা টিম, আর্ট টিম সবাই একে অপরকে, এমনকি লাঞ্চ ব্রেকের সময় প্রোডাকশন টিম কে সাহায্য করে দিত। প্রোডাকশন টিম আর ডিরেকশন টিম ও অন্যদের হেল্প করত। অভিনেতারা পর্যন্ত নিজেদের ফাঁকা সময়ে অন্যদের সাহায্য করতো। আর পরিচালকেরা তো বহু কাজ, শটের প্রয়োজনের জন্য বাজার করা, রান্না, অভিনেতাদের কাপড় পরিস্কার করা, আয়রন করা থেকে হেন কাজ নেই যা নিজেরা করেনি। খুব কম পরিচালকেরা এমনভাবে কাজ করেন। আমি সৌভাগ্যবান যে আমার কর্মজীবনে এমন পরিচালক বেশ কয়েকজন পেয়েছি। যাইহোক, এভাবেই একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একাত্ম হয়ে কাজ করতে করতে ১৪দিন সেই বাড়ির মধ্যে, একদিন আউটডোর এবং আর একদিন অরোরার অফিস ও অরোরার পুরনো স্টুডিও ভেঙে নতুন তৈরি হতে চলা অসমাম্প্ত স্টুডিওতে শুট করে কালকক্ষ শুট শেষ হয়।

 

কালকক্ষ শুটের সময় অভিনেতাদের অভিনয় থ্রু ক্যামেরা দেখা আমার কাছে এক অন্যরকমের অভিজ্ঞতা ছিল। এমন অভিজ্ঞতা কম শুটেই হয়। কালকক্ষে প্রতিটা অভিনেতা নিজেদের অভিনয়ের সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিল। থ্রু ক্যামেরা ওদের অভিনয় একটা অন্যরকমের ফিল দিত। দেখতে দেখতে ক্যামেরার পিছনেই আবেগপ্রবণ হয়ে যেতাম। শট শেষে বা দিনের শেষে আমি অভিনেতাদের আমার এই অভিজ্ঞতা গুলো বলতামও। শ্রীলেখাদি, তন্নিষ্ঠা, অহনা, জনার্দনদা, অমিতদা, দীপ সবাই অন্য লেভেলের অভিনয় করেছে। কিন্তু ছোটো মামণি হিসেবে এই বাচ্চা বয়সে অহনা যা ম্যাচিওরড এবং হাড় হিম করা অভিনয় করেছে সেটাই যেন কালকক্ষর মুড সেট করে দিয়েছিল। তন্নিষ্ঠার মেজ মামণির চরিত্র পরিচালকেরা এমন ভাবে লিখেছে আর তন্নিষ্ঠা তাতে এমন অভিনয় করেছে যে আমি মনে করি এই চরিত্র আর তার অভিনয় পরবর্তীকালে একজন অভিনেতার কাছে টেক্সটবুক হতে পারে। এমন একটা চরিত্র ও তার অভিনেতা তন্নিষ্ঠাকে আমি ভিজুয়্যালি ফুটিয়ে ধরার সুযোগ পেয়েছি এটা আমার পরম প্রাপ্তি। শ্রীলেখাদির কিছু সিনে অভিনয় দেখে মনে হয়েছে বড়ো মামণি আসলেই রক্তমাংসের একজন কেউ, এটা একজন অভিনেতা হতেই পারে না। শ্রীলেখাদি আমাদের সময়ের অনেক আগে থেকেই ভীষণ শক্তিশালী, বৈচিত্র্যময়ী একজন অভিনেতা। আমাদের ইন্ডাস্ট্রি শ্রীলেখাদির মত একজন জাতীয় পুরস্কারজয়ী অভিনেতার অভিনয়সত্তাকে সেইভাবে ব্যবহার করতে পারলো না এটা আমাদের দর্শকদের দুর্ভাগ্য আর আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ব্যর্থতা। জনার্দনদার ডাক্তারের চরিত্রে ওই অভিনয়টা না থাকলে তিন মামণির ওই অভিনয় ফুটে উঠতো না বলেই আমার মনে হয়। ডাক্তারের চরিত্রটা অত্যন্ত কঠিন ছিল। এই প্রসঙ্গে একটা সিক্রেট বলে রাখি। একটা মিড ক্লোজ শট ছিল যেখানে ডাক্তারের পায়ে দড়ি বাঁধা। ডাক্তারের পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে শটটা হবে। এইটার জন্য আমি ডাক্তারের কস্টিউম পরে, পায়ে দড়ি বেঁধে শটটা নি। কালকক্ষে অমিতদার চরিত্র গল্পের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ন। কালকক্ষ ঘরের চরিত্রগুলোর থেকে অন্য মেরুতে দাড়িয়ে থাকা নামহীন ওই চরিত্রে অমিতদা অপূর্ব অভিনয় করেছে। এই চরিত্রকে আমরা যে যে সিনে, যে যে লোকেশনে দেখি তার সিনেমাটোগ্রাফির একটা পার্ট কিন্তু অমিতদা। অমিতদার ওই সিনগুলোতে আমরা ওই চরিত্রকে দেখি ফোনে তার প্রেমিকার সাথে ভিডিওকলে কথা বলতে। সিনগুলো আমি প্ল্যান করেছিলাম আইফোনে শুট করবো আর অভিনেতা নিজেই নিজের ক্যামেরা “অপারেট” করবে। কারণ আমার মনে হয়েছিল এই সিনগুলো বা এই চরিত্র দাবি করছে এটা এইভাবে শুট হোক। আইফোন ১১ দিয়ে কোনো আলাদা লেন্স না লাগিয়েই আমরা শুট করি। সেট লাইট করে অমিতদা কে বুঝিয়ে দিতাম কিভাবে কী করতে হবে। তারপর অমিতদার হাতে ফোন ছেড়ে দিয়ে শট হত। অমিতদা অসম্ভব মুন্সিয়ানার সাথে নিজের অভিনয় তো করেইছে, সাথে বিশ্বাসযোগ্যভাবে ক্যামেরা অপারেট ও করেছে। দীপের ছোটো চরিত্র ছিল। কিন্তু ওর অসম্ভব ন্যাচারাল অভিনয়টা ছাড়া ছোটো মামণির চরিত্র বা কালকক্ষ অসম্পূর্ণ। আমার বিশ্বাস কালকক্ষে অভিনেতাদের পাশাপাশি বাড়িটা, প্রতিটা প্রপস, ফার্নিচার, পর্দা ইত্যাদি এবং অন্যান্য লোকেশন- সবকিছু একসাথে অভিনয় করেছিল যেন।

 

কালকক্ষর দু একটা সিন বা শট সারাজীবন হয়তো আমার মনে থাকবে। যেমন সিনেমার শেষদিকে মেজো মামণির চরিত্রে তন্নিষ্ঠা খালি গলায় একটা গান গায়। ওটার সাথে একটা ট্রলি শট ছিল। এই শটটা নেওয়ার সময় ক্যামেরা অপারেট করতে করতে আবেগে আমার গলা বুজে এসেছিল। মনে হচ্ছিল যেন আমি শুটিং ফ্লোরে নেই, হলে বসেই সিনেমাটা দেখছি। শট শেষে দেখি আমার চোখে জল। তারপর থেকে যতবার এই শটটা আমি দেখেছি, সে পোস্ট প্রোডাকশন এর সময় হোক বা গোয়াতে ইফি (International Film Festival of India) ফেস্টিভ্যালের বিশাল পর্দায়- ততবার আমার চোখে জল এসেছে। বেশকিছু সিনে অদীপ – অনিন্দিতের এমন সাউন্ড ডিজাইন আর অভিজিতের এমন মিউজিক ট্রিটমেন্ট আছে যে পোস্ট প্রোডাকশনের সময় বা পরে কমপ্লিট সিনেমাটা দেখার সময়ে ওই জায়গা গুলো আমাকে ভীষণ হউন্ট করতো। এর পিছনে একটা ব্যক্তিগত কারণও ছিল যেটা পরে বলছি। তখন আমি ওই জায়গা গুলো এলেই কানে আঙ্গুল দিতাম। এখনও আমাকে ওই জায়গা গুলো হউন্ট করে। যতবার সিনেমাটা দেখি ভুলে যাই যে আমি নিজে এটার মেকিং এর সাথে যুক্ত। একজন সাধারণ দর্শকদের মতোই দেখি হয়তো এখনো এটা।

 

কালকক্ষ এক ম্যাজিক রিয়ালিসমের গল্প। আর তার শুটে ম্যাজিক ঘটবে না এটা হতেই পারে না। সত্যি সত্যি শুটে এমন কিছু জিনিস ঘটেছিল যেটা ম্যাজিক ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। আর এই ম্যাজিক গুলো আমাদের সিনেমাকে ভীষণ সমৃদ্ধ করেছিল। পুরো সিনেমা জুড়ে আমাদের মাকড়সার দরকার ছিল যা মনোমত আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওই বিশাল মাকড়সা যেটা দর্শকেরা পর্দায় দেখেন সেটা হঠাৎ করেই চলে আসে আর অদ্ভুত ভাবে আমাদের যা যা শট যেমনভাবে দরকার ঠিক সেইভাবে শট দিয়ে উধাও হয়ে যায়। সব থেকে বড় ম্যাজিক টা ঘটেছিল সিনেমার শেষের আগের সিনে, যেখানে ডাক্তার মামণিদের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পায়। শট অনুযায়ী মেজ মামণি আর ডাক্তার দরজায় দাড়িয়ে। মামণি ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে নিজে আগে দরজার বাইরে পা দেবে, পিছু পিছু ডাক্তারও। ওই শটে আমরা আমাদের ভিজুয়াল প্ল্যান অনুযায়ী অনেক ধোঁয়ার আয়োজন করেছিলাম। ফ্যান আর বাকি সবকিছু রেডি। লাইটও রেডি। আমাদের প্ল্যান ছিল যে ধোঁয়া দরজার বাইরে থাকবে কিন্তু কোনোভাবেই ভিতরে ঢুকবে না। মেজ মামণি আর পিছু পিছু ডাক্তার দরজার বাইরে পা রাখলেই তারা সেই ধোঁয়ার মধ্যে মিলিয়ে যাবে। যেন হঠাৎ তারা উধাও হয়ে গেল। কিন্তু শট নেওয়ার সময় সেই অদ্ভুত ম্যাজিকটা ঘটলো। ঠিক যেই মুহূর্তে মেজ মামণি আর ডাক্তারের সংলাপ শেষ হল অমনি দরজার বাইরের ধোঁয়া আপন খেয়ালে কুণ্ডলী পাকিয়ে এক ছলনাময়ী নর্তকীর মত নাচতে নাচতে ঘরের ভিতরে ঢুকতে শুরু করলো। ঘরের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে সে তার নাচ বাড়াচ্ছে আর মামণি ও ডাক্তারকে প্রায় আবছা করে দিয়েছে। এই সময় মামনি শটের চাহিদা মত দরজার বাইরে পা দেয়, পিছু পিছু ডাক্তারও। দরজার বাইরে পা রাখতেই তারা ধোঁয়ার রাজ্যে হারিয়ে যায়। ঠিক যেই মুহূর্তে তারা মিলিয়ে গেল অমনি ঘরের ভিতর থেকে সেই কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া বাইরে বেরিয়ে যেতে থাকলো। এই দৃশ্য, এই ম্যাজিক শুটিং ফ্লোরেই আমাদের এমন আশ্চর্য্যচকিত করে দিয়েছিল যে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত সবকিছু দেখছি। কাট যে বলা হয় নি কেউ খেয়াল করেনি। এই ম্যাজিক ওই দৃশ্য কে আমাদের পরিকল্পনার বাইরে যে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে তা বলাই বাহুল্য।

 

জানুয়ারি মাসে আমরা শুটিং শেষ করি। কিছুদিনের মধ্যেই এডিট শুরু হয়। রাফ কাট শেষ হওয়ার মুখে আমার জীবনে বিপত্তি নেমে আসে। আমি কোভিড আক্রান্ত হয়ে বাঙ্গুর হসপিটালে ভর্তি হই। তখন প্রথম ওয়েভের শেষদিক। ফলে আমি যখন বাঙ্গুরে ভর্তি হই তখন আমার ওয়ার্ডে মাত্র তিনজন রুগী। ৪/৫দিনের মাথায় তারা সবাই সুস্থ হয়ে ছাড়া পেয়ে গেল আর আমি গোটা ওয়ার্ডে একা হয়ে গেলাম। এই সময় থেকেই কোভিড জনিত কারণে শরীর দুর্বল হতে থাকে আর ওয়ার্ডে একা রুগী হিসেবে থাকাটা মানসিকভাবে আমাকে প্রচন্ড বিপর্যস্ত করতে থাকে। বাইরের জগতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন আমি আর কালকক্ষর ডাক্তারের মধ্যে তখন যেন কোনো তফাত নেই, প্রেক্ষাপট টুকু বাদ দিয়ে। সময়কে তখন ঠিক তেমনটা মনে হতো যেমনটা স্ক্রিপ্টে ডাক্তারের বা অন্যদের মনে হতো। আর সারাদিন এইসব ভাবনা আমাকে ভিতরে ভিতরে তোলপাড় করতো। ডাক্তারের মতো আমারও মনে হতো আমার সাথে কেউ রসিকতা করছে যেন, কেউ যেন আমাকে নিয়ে মজার একটা খেলা করছে। ফলে কালকক্ষ যেন সবসময় আমাকে হসপিটালে তাড়া করে বেড়াত। মনে হতো আর কোনোদিন বাইরে বেরোতে পারবো না, আর কোনোদিন আমার ক্যামেরায় চোখ রাখা হবেনা। অন্তত একবার মা কে দেখার আর কালকক্ষ কে কমপ্লিট সিনেমা হিসেবে দেখার আকুল অপেক্ষায় থাকতে থাকতে প্রচন্ড দুর্বল শরীরে অবশেষে ঠিক ১৪ দিন পরে হসপিটাল থেকে ছাড়া পেলাম। অদ্ভুত সমাপতন হল যে আমরা কালকক্ষর বাড়িতে শুট ও করেছিলাম মোট ১৪ দিন!

 

ইতিমধ্যেই খবর পেয়েছি কালকক্ষর রাফ কাট শেষ হয়ে ডাবিং এবং অন্যান্য কাজ শুরু হয়েছে। হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি আমার বাড়ি কাটোয়া চলে যাই। কিন্তু কোভিড পরবর্তী নানা জটিলতায় ভুগতে থাকি। একটা সময় মনে হয় হয়তো পোস্টের কাজে আমি থাকতেই পারবো না। কিন্তু জোর করেই কলকাতা ফিরে আসি। শর্মিষ্ঠাদি আমার রুগ্ন শরীরের কথা ভেবে আমাকে তাদের বাড়িতে রাখে । ইতিমধ্যে ফাইনাল কাটও শেষ হয়েছে। কলকাতা ফিরে এসে ফাইনাল কাট দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। প্রথম গল্প শুনে, স্ক্রিপ্ট নিয়ে মাসের পর মাস কাটিয়ে, প্রচুর কিছু প্ল্যান করে যে কালকক্ষ ভিসুয়ালাইজ করেছিলাম, যা আমরা শুট করেছি আর হসপিটালে বসে যে কালকক্ষ সিনেমা হিসেবে ভেবে ভেবে আমি তোলপাড় হয়েছিলাম এটা সেসব ছাপিয়ে আরো অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এই ঘোর কাটতে একটু সময় লেগেছিল। সেদিনই তৃতীয়বার কালকক্ষ দেখে আমি পরিচালকদের বলেছিলাম যে কালকক্ষ সময়ের সিনেমা হয়েছে আর এটা দর্শকের কাছে সময় দাবি করবে। সচরাচর এমন সিনেমা ভারতবর্ষে হয় না। একে বুঝতে গেলে অনেকবার দেখতে হবে। যতবার দেখবো তত এর ভিতরের স্তরগুলো চোখের সামনে খুলতে থাকবে। পরে অনেকেই কালকক্ষ দেখে নানা জায়গায় নানা ভাবে প্রায় এই বক্তব্যই প্রকাশ করেছেন।

 

কালার কারেকশন ও গ্রেডিং এর কাজ শুরু হতেই আমার বাঁ পায়ে স্ট্রেস ফ্র্যাকচার ধরা পড়ে। ডাক্তারের কমপ্লিট রেস্ট এর পরামর্শ উড়িয়ে জোর করে পায়ে নি-ব্রেস আর হাতে লাঠি নিয়ে পোস্টের কাজে আসতে থাকি। এইসময় শর্মিষ্ঠাদির বাড়িতে থাকায় আমার ভীষণ উপকার হয়েছিল। মাঝে একদিন এই অবস্থাতেই পরিযায়ী শ্রমিকদের কিছু দৃশ্য আইফোনে শুট করি। অনেকটা সময় ধরে, প্রায় দেড় মাস মত, আমরা গ্রেডিং এর কাজ করি। আমাদের কালারিস্ট কৌশিকদা অসামান্য কাজ করেছে। কালকক্ষ নিয়ে আমার যা ভিশন ছিল সেটাকে ঠিকঠাক রূপদানের এই প্রসেসে কৌশিকদা দক্ষতার সাথে কাজ করেছিল। প্রতিটা দিন কৌশিকদা আর আমি অন্ধকার ঘরে প্রতিটা শট, প্রতিটা সিন ধরে ধরে ধৈর্যের সাথে, যত্ন সহকারে কাজ করেছিলাম। এই কোলাবরেশন এর ফল এখন পর্দায় দেখতে পাওয়া যায়।

 

ইতিমধ্যে সাউন্ড মিউজিক সব শেষ হয়েছে। পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ মোটামুটি শেষ হওয়া মাত্রই সেকেন্ড ওয়েভের কারণে আবার লকডাউন। আবার আমরা ঘরের মধ্যে। এর মধ্যেই সাউন্ড এর কাজের ফাইনাল টাচ শেষ হয়। পুরো সিনেমা আউট নেওয়া হয়। ঘরে বসেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটা পাঠানো শুরু হয়। শুরুর দিকে কানস, ভেনিস এবং আরো কয়েকটা ফেস্টিভ্যাল থেকে রিজেকশন মেল আসে। কিছুটা মুষড়ে পড়লেও আমরা কখনোই হাল ছাড়িনি। এর মধ্যেই আমরা সিনেমাজগতের সাথে যোগ নেই এমন কিছু মানুষকে আমাদের সিনেমাটা দেখাই। ফিল্ম চলাকালীন তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমরা ফলো করি, যাতে বুঝতে পারি তারা সিনেমাটা, এর ন্যারেটিভকে কীভাবে নিচ্ছেন। দেখা শেষে তাদের সাথে কথা বলি। আশ্বস্ত হই যে সিনেমাটা তাদের টাচ করছে। পরে সিনেমাজগতের কিছু মানুষকেও আমরা দেখাই। সবাই ভালো মন্দ নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেন। কিছু মানুষ এবং কিছু ফেস্টিভ্যাল থেকে আমাদের নানা পরামর্শ দেওয়া হয় যে সিনেমার লেংথ আজকের দিনে দাড়িয়ে বড্ড বেশি। ছোটো করা উচিত। নাহলে মানুষ দেখবে না। ফেস্টিভ্যালে নেবে না। হল রিলিজ করা যাবে না। ফেস্টিভ্যাল কিউরেটর, বিদেশি ডিস্ট্রিবিউটর না ধরলে কোনো ফেস্টিভ্যালে আমরা জায়গা পাবো না। এইরকম অনেক মতামত। কিন্তু, আমরা নিজেদের উপর বিশ্বাসে আর নিজেদের ভিশনে অটল ছিলাম। যার সুফল কিছুদিনের মধ্যেই পাই। কালকক্ষ বুসান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, ২০২১ এর নিউ কারেন্টস প্রতিযোগিতা বিভাগে সিলেক্টেড হয়। এটাই কালকক্ষর ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার। বহু বছর পরে কোনো বাংলা ভাষার সিনেমা আবার বুসান এর কম্পিটিশনে সিলেক্টেড হল। এটা আমাদের কাছে ভীষণ গর্বের বিষয় ছিল। দুর্ভাগ্য যে সেই সময় আন্তর্জাতিক যাতায়াতে কোভিড সংক্রান্ত প্রচন্ড কড়াকড়ি, বিধিনিষেধের ফলে আমরা আমন্ত্রণ সত্বেও সশরীরে বুসান যেতে পারিনি। বুসান এ আমাদের সিনেমা ভীষণভাবে প্রশংসিত হয়। এরপরে ধীরে ধীরে দেশ বিদেশের অনেক সম্মানীয় ফেস্টিভ্যালে আমাদের সিনেমা সিলেক্টেড হতে থাকে। অনেক ফেস্টিভ্যালের ডিরেক্টর নিজেরা মেল করে আমাদের সিনেমা চেয়ে পাঠান। আমাদের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার হয় গোয়াতে ইফি ফেস্টিভ্যালে (International Film Festival of India) ইন্ডিয়ান প্যানোরামা বিভাগে। ২০২১ এর নভেম্বরে অঞ্জনদা, রাজদীপদা, শর্মিষ্ঠাদি, শ্রীলেখাদি ও আমি গোয়া যাই। ইফিতে কালকক্ষ ভীষণভাবে সমাদৃত হয়। দর্শকদের সাথে, সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারি যে বাংলা ভাষার সিনেমা কালকক্ষ ইংরেজি সাবটাইটেলে দেখে অন্য ভাষার মানুষের অনুধাবন করতে অসুবিধে হচ্ছে না। আমাদের ভয় ছিল কালকক্ষর কিছু জিনিস একান্তই বাঙালি আবেগের কাছেই হয়তো ধরা দেবে, অন্য ভাষার মানুষের কাছে হয়তো সেইভাবে ধরা দেবে না। আমাদের সেই শঙ্কা দূর হল ইফির পরে।

 

ইফিতে আমার খুব সুখকর এক অভিজ্ঞতা হয় যা আজীবন আমার সাথে থাকবে। স্বনামধন্য সিনেমাটোগ্রাফার অসীম বোস, যিনি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং আরো অনেক পরিচালকের সাথে কালজয়ী সব সিনেমা করেছেন, সেবার জুরি বোর্ডে ছিলেন। অসীম স্যারের অনেক কাজ দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। তিনি জুরি হিসেবে ইতিমধ্যে কালকক্ষ দেখেছেন। ইফিতে আমাদের ছবির স্ক্রিনিং এর দিন স্ক্রিনিং এর আগে ও পরে স্যারের সাথে ঘণ্টার পর ঘন্টা কালকক্ষ, আমার সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে প্রচুর কথা হয়। স্যার অনেক কিছু আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করেন। কেন করেছি, কীভাবে করেছি। প্রচুর সিন নিয়ে, আলো নিয়ে, টেকনিক্যাল দিক নিয়ে কথা হয়। সিনেমাটোগ্রাফি এবং ফিল্মমেকিং নিয়েও অনেক কথা হয়। এই আলোচনা যতদিন গোয়া ছিলাম চলেছিল। স্যারের সাথে ওই সুদীর্ঘ আলোচনা আমার কাছে মনিমুক্তর মত। আমার ফিউচার কেরিয়ার নিয়ে স্যার অনেক সুপরামর্শ দিয়েছিলেন। এখনও ভালো সময়, খারাপ সময়ে স্যারের কথাগুলো মনে করি, মেনে চলতে চেষ্টা করি। কালকক্ষ সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে স্যারের বলা কথাগুলো আমার কাছে অ্যাওয়ার্ডের সমান। স্যারের কাছে এজন্য আমি আজীবন ঋণী থাকবো। একজন লিজেন্ডারি সিনেমাটোগ্রাফার হয়ে সদ্য কাজ শুরু করা একজন সিনেমাটোগ্রাফারকে উনি যে সম্মান দিয়েছিলেন তা আজকের দিনে বিরল। এই ফেস্টিভ্যালেই আমি আরো দুই নমস্য সিনেমাটোগ্রাফার এ.কে. বির স্যার এবং সাজি এন করুন স্যারের সঙ্গে দেখা করার এবং দীর্ঘক্ষণ কথা বলার সুযোগ পাই। প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে কথা বলার ব্যাপারে শ্রীলেখাদি আমাকে ভীষণ সাহায্য করেছিলেন। একসময় যাঁদের কাজ দেখে বড় হয়েছি, যাঁদের কাজ আমাকে সিনেমাটোগ্রাফার হতে সাহায্য করেছে তাদের সঙ্গে সময় কাটানো ও তাঁদের মূল্যবান উপদেশলাভ সম্ভব হয়েছে কালকক্ষর জন্য।

 

মহামারীর তৃতীয় ওয়েভের কারণে ২০২২ সালে পূর্ব নির্দিষ্ট সময়ে কালকক্ষর মুক্তি দুবার পিছিয়ে যায়। এর মধ্যে এপ্রিল মাসে আমাদের সেম টিম অরোরার পরের ছবি মনপতঙ্গ শুট শুরু করি। শুট শেষের পরে ২০২২ সালের ১৯শে আগস্ট কালকক্ষ সিনেমাহলে মুক্তি পায়। হল এবং শো টাইম পাওয়া নিয়ে অঞ্জনদা কে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এই হ্যাপা কম বেশি সব ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি করিয়েদের আজকাল পোহাতে হচ্ছে। তবুও, যে ছবি বুসান, ইফির মত ফেস্টিভ্যালে ঘুরে আসে এবং দেশ বিদেশে গৃহীত ও প্রশংসিত হয় সেই সিনেমার মধ্যে কিছু তো নিশ্চয় আছে যাতে সেখানকার মানুষজন, দর্শক আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাহলে ঠিকঠাক হল বা শো টাইম কেন পাওয়া যাবে না এর সদুত্তর তখন পাওয়া যায় নি। রিলিজের আগে অনেক ডিস্ট্রিবিউটররা অঞ্জনদাকে বলেছিলেন যে আমাদের সিনেমায় স্টারকাস্ট নেই, একদম নতুন ছেলে মেয়েদের সিনেমা, পরিচালক নতুন, টিম ও প্রায় নতুন, সিনেমার বিষয় বড্ড “ডার্ক এবং জটিল”, মহামারী কাটিয়ে আসা মানুষ এই সিনেমা আর দেখবেনা হয়তো ইত্যাদি। সিঙ্গল স্ক্রিন, মাল্টিপ্লেক্স মিলিয়ে যত গুলো স্ক্রিন আর শো টাইম কালকক্ষ পাবে বলে ডিস্ট্রিবিউটররা কথা দিয়েছিলেন আদপে তার কিছুই পায় নি। অথচ ঠিকঠাক হল আর শো টাইম পাওয়ার জন্য অঞ্জনদা আর পরিচালকদের দোরে দোরে ঘুরতে হয়েছে। রিলিজের আগেরদিনও এমন হয়েছে যে বুকমাইশোতে যে যে হল বা মাল্টিপ্লেক্স এর নাম দেখাচ্ছে আমরা সেগুলো নিয়ে প্রচার করছি, কিছুক্ষন পর দেখি যে সেই হল বা মাল্টিপ্লেক্স থেকে শো তুলে দেওয়া হয়েছে। এর কোনো সদুত্তর ডিস্ট্রিবিউটর অঞ্জনদাকে দেখাতে পারেনি। কালকক্ষ, তার পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা এবং বাকী টিম দেশ বিদেশে যে সম্মান পেয়ে এসেছে সেই সম্মান নিজের শহর কলকাতায় ছবি মুক্তির আগে ডিস্ট্রিবিউটর বা ইন্ডাস্ট্রির উপরমহল থেকে পায় নি। যাইহোক, কোনরকমে ১৯শে আগস্ট কলকাতার নন্দন-২, নজরুল তীর্থ, সিনেপলিস আক্রপলিস, আইনক্স হাইল্যান্ড পার্ক, পিভিআর মানি স্কোয়ার, পিভিআর ডায়মন্ড প্লাজা এই ৬টি হলে সর্বসাকুল্যে ৬টি শো আর ব্যাঙ্গালোরের ফিনিক্স মার্কেট হলে একটা শো নিয়ে মুক্তি পেল। মুক্তির পরেও হাজারটা সমস্যা। একে তো ঠিকঠাক শো টাইম দেয় নি। তার উপরে কিছু কিছু মাল্টিপ্লেক্সে দর্শকরা সশরীরে গিয়ে টিকিট কাটতে গেলে তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে বা মিথ্যে বলা হয়েছে যে শো নাকি ক্যানসেল করা হয়েছে। অথচ বুকমাইশো তে দেখাচ্ছে শো ক্যানসেলড না। কখনো নির্দিষ্ট সিনেমার নাম করে বলা হয়েছে সেটা দেখুন। দর্শকেরা এই নিয়ে ঝামেলা করলে তখন তারা বাধ্য হয়েছে টিকিট বিক্রি করতে। এই নিয়ে সেই সময় সোশ্যাল মিডিয়াতে লেখালেখিও হয়েছিল। মাল্টিপ্লেক্স নিয়ে এই অভিযোগ আগেও অনেক সিনেমার ক্ষেত্রে হয়েছিল। তখনও কোনো সুরাহা হয় নি। আমরাও এর কোনো সমাধান খুঁজে পাই নি। ফলে তিনদিন পরে সমস্ত মাল্টিপ্লেক্স থেকে আমাদের সিনেমা তুলে নেওয়া হয়। নন্দন-২ এবং নজরুল তীর্থতে ভালোই লোক হচ্ছিল। নন্দন-২ যাতায়াতের সুবিধার জন্য বেশি লোক হচ্ছিল। শনি, রবি হাউসফুল ও হয়। আমরা অনেক হল ভিজিট করি। দর্শকদের সাথে কথা বলি। তাদের উচ্ছসিত প্রশংসা আমাদের আপ্লুত করে। সোশ্যাল মিডিয়াতে দর্শকদের লেখালেখি শুরু হয়। একটা দর্শক চাহিদা নিজের মত তৈরি হতে থাকে। ঠিক এমন মুহূর্তে কালকক্ষ দুই সপ্তাহ পরে নন্দন-২ ও নজরুল তীর্থ থেকেও সরে যায়। কালকক্ষর সিনেমাহল জার্নি এখানেই শেষ।

 

একবছর পরে ২০২৩ সালের ঠিক সেই আগস্ট মাসেই কালকক্ষ শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেল। দিনটা ছিল ২৪শে আগস্ট। ডাক্তারের কাছে যাবো বলে তখন আমি অটোতে। দেখি বারবার কল আসছে। যাদবপুর ৮বি তে নেমে দেখি আমার বন্ধু স্বর্নাভর ফোন। ওই প্রথম আমাকে এই পুরস্কার প্রাপ্তির খবর দেয়। খবরটা শোনার পর থেকে উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। তারপর তো অজস্র ফোন, মেসেজ, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, অজস্র শুভেচ্ছাবার্তা। অঞ্জন দা, পরিচালক, অভিনেতা, টিমের বাকি সবাই, লাইট বয়, ক্যামেরা কেয়ারটেকার, লাইট ভেন্ডার, কামেরা হাউস সবাইকে ফোন করি। সবাইকে আমরা শুভেচ্ছা জানাই কারণ সেই দিনগুলো সবাই মিলে নিজেদের সবকিছু উজাড় করে পাশে না থাকলে কালকক্ষ আজকের কালকক্ষ হয়ে উঠতে পারত না। ধন্যবাদ সমস্ত দর্শকদের যারা নানা বাধা সত্ত্বেও হলে গিয়ে, তার আগে নানা ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটা দেখেছেন, লেখালেখি করেছেন। ধন্যবাদ সেই সকল দর্শকদেরও যারা সিনেমাহল থেকে কালকক্ষ তুলে নেওয়ার পরেও নানা ভাবে সিনেমাটা দেখতে চেয়েছেন এবং জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির পরে কালকক্ষর আবার সিনেমাহলে রিলিজের জন্য সোচ্চার হচ্ছেন। এই জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তি তাই ভালো সিনেমার পাশে থাকা সকল দর্শকদের। আর অবশ্যই এই স্বীকৃতি সেইসব অপমান, কটূক্তির জবাব যা সিনেমাটা বানানোর সময় থেকে হলে রিলিজ পর্যন্ত নানা ভাবে অঞ্জনদা, রাজদীপদা, শর্মিষ্ঠাদি কে মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এই স্বীকৃতি সেইসব অপমান, কটূক্তির যোগ্য জবাব যা বর্তমান সময়ে সমস্ত ইন্ডিপেন্ডেন্ট, অন্যধারার, ভিন্ন ভাবনাচিন্তার ফিল্মমেকার দের সিনেমা বানাতে গিয়ে, দর্শকদের কাছে সেই সিনেমা দেখাতে চেয়ে হজম করতে হয়।

 

তবে, জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির পরেই যে কালকক্ষর সুদিন ফিরে এল বা বা কালকক্ষর মত ছবির সুদিন ফিরে আসবে এটা বলতে পারছি না। জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির পরে এখনও কালকক্ষ রি রিলিজের জন্য সিঙ্গল স্ক্রিন, মাল্টিপ্লেক্স পাওয়া সহজ হচ্ছে না! একটা মাল্টিপ্লেক্স চেন রাজি হলেও তারা একটাই স্ক্রিন দিতে চায় আর যে শো টাইম তারা দিতে চাইছে সেই সময়ে কালকক্ষর মত ছবির দর্শকের যাওয়া অসম্ভব। একবার ভাবুন, দর্শক চাহিদা সত্বেও, একটা সিনেমা জাতীয় পুরস্কার লাভের পরেও হল পাচ্ছে না। এই হল আর ঠিকঠাক শো টাইম পেতে কালকক্ষ কে আর কোন অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে আমাদের জানা নেই। কারোরই জানা নেই। আমার মনে হয় এবার সময় এসেছে সাধারণ মানুষ, দর্শক এই বাজারি সিস্টেমটাকে প্রশ্ন করা শুরু করুক। তারাই এই বাজারের দোহাই দিয়ে পার পেয়ে যাওয়া ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম আর পিছনের মাথাগুলোকে এবার এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য বাধ্য করুক। এই ক্ষতি আসলে বাংলা সিনেমা আর সিনেমাপ্রেমী দর্শকদেরও। সুখের খবর এটাই যে একমাত্র নন্দন ও রাধা স্টুডিও কতৃপক্ষ (এই লেখাটার সময় অব্দি) কালকক্ষর জন্য এগিয়ে এসেছেন। নন্দন-১ ও রাধা স্টুডিওতে কালকক্ষ সেপ্টেম্বর মাসের ৮ তারিখে পুনরায় মুক্তি পেল।

 

কালকক্ষ কেন সিনেমার ইতিহাসে থেকে যাবে? বেশ কিছু প্রথমসারির ফেস্টিভ্যালে ঘুরেছে বলে? জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে বলে? একদমই না। কালকক্ষ একটা ম্যাজিক রিয়ালিজম এর ছবি। কালকক্ষ একটা শাশ্বত সত্যের, চিরন্তন মূল্যবোধের ছবি। এই ছবি আমাদের একটা জীবনবোধের শিক্ষা দেয়। কালকক্ষর পরতে পরতে যেমন একটা সময়কে ধরা আছে, তেমনি সেই সময়কে ছাপিয়ে গিয়ে একটা অনন্ত সময়ের কথাও বলা আছে। কালকক্ষ মাল্টিলেয়ার্ড একটা সিনেমা। কালকক্ষ আপনাকে বাঁচতে শেখাবে। কালকক্ষ আপনাকে একটা রূপকথার দুনিয়ায় নিয়ে যাবে, যে দুনিয়ায় হাজারটা খারাপ সত্বেও ভালো জিনিস এবং শুভবুদ্ধির জয় হয়। নিজেদের অন্য মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখায়, গড়তে শেখায় কালকক্ষ। কালকক্ষ ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে ভীষণ রকম বাঁচার ছবি।। কালকক্ষর জার্নির সাথে আমার জার্নি, আমার ব্যক্তিগত জীবন, সংগ্রাম, উপলব্ধি যেভাবে মিশে গেছে সেটা সহজে অন্য কোনো ছবির ক্ষেত্রে হওয়া কঠিন আছে। কালকক্ষ এবং এর মেকিং এর যে জার্নি সেটা যেমন আমার সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে নিজেকে প্রকাশের সংগ্রামকে মান্যতা দিয়েছে, সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে আমার উত্তরণ ঘটিয়েছে, সিনেমাটোগ্রাফি সংক্রান্ত আমার ভাবনাচিন্তা গুলো যে ভুল নয় সেই ভরসা দিয়েছে, তেমনি আমার জীবনবোধ ও দর্শনকেও অনেকটা পাল্টে দিয়েছে।

 

সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কালকক্ষ আমার কাছে বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রথমত এমন একটা স্কেলের সিনেমাকে ভিজুয়্যালি ভাবা এবং তার সার্থক রূপদান কঠিন ছিল। কিন্তু প্রথমদিন থেকেই আমি পরিচালকদের থেকে, প্রযোজকের থেকে অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছি। সচরাচর এমন স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। এটা ভীষণভাবে আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছিল। রাজদীপদা, শর্মিষ্ঠাদি ও আমি প্রথমদিন থেকেই নিজেদের ভাবনা চিন্তা শেয়ার করতাম। প্রথমদিন থেকে জড়িয়ে থাকার ফলে শুরু থেকেই পরিচালকেরা কী চায় সেটা আমার কাছে পরিষ্কার ছিল। প্রচুর কিছু নিয়ে আমাদের আলোচনা চলত। এইসব আলোচনা আর ব্যক্তিগত যে প্রি প্রোডাকশন আমি নিজে নিজে করে থাকি এইসব থেকেই ধীরে ধীরে ইমেজ, আলো, মুভমেন্ট এইগুলো স্পষ্ট হতে থাকে আর আমি পরিচালকদের সেগুলো বলতে থাকি। সেইসব নিয়ে আবার অনেক আলোচনা, মতামত বিনিময় হতে থাকে। অভিনেতাদের রিহার্সাল, স্ক্রিপ্ট নিয়ে তাদের ভাবনা চিন্তাও এই পর্যায়ে আমাকে অনেকটা সমৃদ্ধ করে। বাজেট আমাদের কম ছিল। বেশি লোকবল আমাদের ছিল না। আমরা শুট করেছি নামমাত্র আলো দিয়ে। যেসব আলো আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এখন প্রায় বাতিলের খাতায় সেইসব ব্যবহার করেছি। কিছু আলো নিজের প্রয়োজনমতো বানিয়ে নিয়েছিলাম। হ্যারিকেন, মোমবাতি ইত্যাদিও অনেক ব্যবহার করেছি আলো করার ক্ষেত্রে। ন্যাচারাল আলো তো ছিলোই। ক্যামেরা ব্যবহার করেছিলাম Blackmagic Pocket 6K, সাথে Zeiss CP3 লেন্স সেট আপ। সেইসময় অনেকেই বারণ করেছিলেন শুনে যে এই ক্যামেরায় কোরো না। অঞ্জনদাও জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আরো বেটার ক্যামেরা দরকার হলে উনি চেষ্টা করে দেখবেন দিতে পারবেন কিনা। কিন্তু আমার কাছে এটা বাজেট এর বিষয় ছিল না, বরং একদম এস্থেটিক এর দিক দিয়ে সিদ্ধান্ত ছিল যে এই সিনেমাটা এই ক্যামেরাতেই করবো, অন্য কোনো ক্যামেরায় না। সেইভাবেই কিছু অংশ আইফোনে শুটের সিদ্ধান্ত হয়। আর শুরু শেষের সিনগুলো বাদ দিয়ে বাকি সিনেমা হ্যান্ডহেল্ড শুটের সিদ্ধান্ত নি। এইসব সাহস দেখানোর ক্ষেত্রে সবসময় আমি পরিচালক, প্রযোজকের প্রশ্রয় পেয়েছি। আমরা সবাই অন্যভাবে কিছু করতে চেয়েছিলাম যা কালকক্ষর স্ক্রিপ্ট দাবি করছিল। সাহস নিয়েছিলাম, নিজেদের ছাপিয়ে গিয়ে কাজ করেছিলাম বলেই হয়ত কিছুটা সফল হয়েছি। আবার আজ যখন সিনেমাটা দেখি, তখন অনেক জায়গায় নিজের কাজে ভুল চোখে পড়ে, অনেক জায়গা আছে যেখানে আরো ভালো করতে পারতাম বা অন্যরকমভাবে করতে পারতাম বলে মনে হতে থাকে। তখন একটু খারাপ লাগে যে কেন এইসব সেইসময়ে মাথায় আসে নি। কিন্তু, দিনের শেষে মানুষের কালকক্ষ যে ভালো লেগেছে এটাই স্বস্তির।

 

আমরা এখনো জানিনা আমরা কালকক্ষ বানানোর মধ্যে দিয়ে সময়কে বদলে দিতে চেয়েছিলাম নাকি সময় আমাদেরকে দিয়ে কালকক্ষ বানিয়ে আসলে আমাদেরকে আর আমাদের চারপাশকে বদলে দিতে চেয়েছিল।