keyboard_arrow_up
keyboard_arrow_down
keyboard_arrow_left
keyboard_arrow_right

সৌম্যেন্দু রায়- আমার রায় স্যার

Start Reading

(***** আমার প্রিয় মানুষ, প্রিয় সিনেমাটোগ্রাফার সৌম্যেন্দু রায় স্যারের কাছে ‘রূপকলা কেন্দ্র’-এ ক্লাস করা, তাঁকে কাছ থেকে দেখা ইত্যাদি নিয়ে একটা স্মৃতিচারণ মূলক লেখা ‘চৌরঙ্গী’ সাহিত্য সংস্কৃতি পত্রিকার ‘সৌম্যেন্দু রায় বিশেষ সংখ্যা’য় ছাপা হয়েছিল। সেটা ২০২২ সালে। এর জন্য আমি ‘চৌরঙ্গী’ পত্রিকা আর সংখ্যা সম্পাদক সোহম দাস এর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তখনও স্যার বেঁচেছিলেন। কিন্তু আজ প্রায় এক বছর হতে চলল স্যার আর নেই। আজ শিক্ষক দিবসে স্যারের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে চৌরঙ্গীতে ছাপা সেই পুরোনো লেখাটা কিছুটা পরিমার্জন আর সম্প্রসারণ করে আবার প্রকাশ করলাম। এই লেখার প্রচ্ছদের ছবিটা সৌম্যেন্দু রায় ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া।)

 

 

সৌম্যেন্দু রায়। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিনেমাটোগ্রাফারদের মধ্যে তিনি একজন। দুনিয়াজোড়া তাঁর নাম ডাক। তবে আমার কাছে তাঁর ঐসব পরিচয় ছাড়াও আরো একটি পরিচয় আছে। উনি আমার ‘রায় স্যার’।

 

স্যারকে আমার প্রথম দেখা ‘নন্দন’-এ ‘রূপকলা কেন্দ্র’-এর একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সময়। ২০০৭ এ সম্ভবত। তখন আমি কলেজ ছাত্র। স্যারের সেই সৌম্যদর্শন উপস্থিতিটা আমার মনে ভীষণ ভাবে গেঁথে গেছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম ‘সিনেমাটোগ্রাফার’ মানে সবাই অবিকল এমনই একজন। এর বাইরে কিছু হতেই পারে না।


এরপর, ২০১১ সালে আমি ‘রূপকলা কেন্দ্র’-এ ‘সিনেমাটোগ্রাফি’ নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হই। প্রথম প্রথম সবার মতো স্যারকে ভীষণ ভয় পেতাম। কাছে যেতে বুক কাঁপতো। কথা বলতে গেলে শব্দ যেন গলার ভিতরে আটকে থাকতো। সে এক সময় গেছে। ফিল্ম স্কুলে প্রথম সেমিস্টারে সবাইকে সবকিছু নিয়েই পড়তে হয়। ফলে স্যারের ক্লাস একটু কম পেতাম। কিন্তু প্রথম সেমিস্টারের ওই অল্প ক্লাসের মধ্যেই চমকে গেছিলাম যেভাবে তিনি প্রকৃতিকে অবজার্ভ করতে শেখালেন। কীভাবে দিনের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ঋতুতে প্রাকৃতিক আলো দেখতে হয়, চিনতে হয়, বুঝতে হয় সেটা তিনি পাশে থেকে, সাথে ঘুরে ঘুরে শেখালেন। আলোর যে বৈচিত্র্যময় অসীম একটা জগৎ সেটার সন্ধান ওঁর হাত ধরে পেলাম। স্যারের থেকে এই আলো চিনতে শেখা আর নিজের চারপাশকে ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখতে শেখাটা আমার সারাজীবনের সম্পদ। আমি ‘সিনেমাটোগ্রাফার’ হওয়ার দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেলাম।


দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকে আমি ‘সিনেমাটোগ্রাফি’ স্পেসালাইজেশানে ঢুকি এবং পুরোপুরি রায় স্যারের ছত্রচ্ছায়ায় চলে আসি। তখনও ভয় কাটেনি একটুও। শুরুর দিকে ক্লাসে আমি কিছুতেই কিছু ঠিকঠাক করে উঠতে পারছিলাম না। স্যার যাই প্রাকটিস করতে দিতেন - সে ‘ক্যামেরা মুভমেন্ট’ হোক, কি ‘ফ্রেমিং’ হোক কি ‘লাইটিং’ কিচ্ছু ঠিকঠাক পারতাম না।   প্রচণ্ড ডিপ্রেসড লাগতো দিনের শেষে। একদিন খুব ভয়ে ভয়ে ক্লাসের শেষে স্যারকে একা পেয়ে বলে বসলাম, স্যার, আমি সিনেমাটোগ্রাফি ছেড়ে দেবো কারণ আমার মনে হয়েছিল আমার দ্বারা সিনেমাটোগ্রাফি হয়ত হবে না। স্যার খুব মন দিয়ে সব শুনে আমাকে অত্যন্ত দামী উপদেশ দিয়েছিলেন, যেটা এখনও আমার মনে আছে এবং সারাজীবন মেনে চলার চেষ্টা করছি। স্যার বলেছিলেন, ‘সব মানুষের মধ্যেই নিজস্বতা থাকে’। আর আমি যখন সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে পড়তে এসেছি তার মানে একটা কোথাও এই বিষয়ের মধ্যে আমি এমন কিছু নিশ্চয়ই পেয়েছি যাতে আমার মনে হয়েছে এর মধ্যে দিয়ে আমি আমার নিজস্বতা, চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে পারবো।

 

সুতরাং, আমি কী পারছি, না পারছি, বাকিরা কী করছে, না করছে, সিনেমাটোগ্রাফির টেকনিক্যাল জটিলতা, সব ভুলে গিয়ে শুধু যেন মাথায় রাখি যে এর মধ্যে আমাকে জীবনের সব আনন্দ, আমার ভালো লাগাটা খুঁজে পেতে হবে। আমাকে নিজের মতো করে নিজের কথা গুলো বলতে হবে ক্যামেরা আর আলোর মাধ্যমে। এই ভালো লাগাটা, এই প্রকাশভঙ্গিটা যেদিন খুঁজে পাবো সেদিন থেকে আমাকে আর পিছন ঘুরে তাকাতে হবে না। আর যদি এসব কিছু না পাই তাহলে যেকোনো সময় আমি ছেড়ে যেতে পারি। স্যার আমাকে আটকাবেন না।


আমাকে কিছুই ছেড়ে যেতে হয়নি। হঠাৎ একসময় দেখলাম সত্যি এবার নিজেকে একটু একটু করে খুঁজে পাচ্ছি। স্যারের কথা গুলো একটু একটু করে সত্যি হতে দেখছি। সেই থেকে ‘সিনেমাটোগ্রাফি’, ‘রূপকলা কেন্দ্র’ আর স্যারের ক্লাস আমার ধ্যান জ্ঞান হয়ে উঠল।

 

রায় স্যারের ক্লাস নেওয়াটা বাকি সবার থেকে আলাদা ছিল। ভীষণ ইন্টারেস্টিং। স্যার যেভাবে আমাদের সবকিছু শেখাতেন, কোথাও মনে হত না যে 'ক্লাস' করছি। মনে হত, একটা ফিল্ম শুটের সেটে যেন স্যারের ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট’ হিসাবে কাজ করছি। শুনেছি আগেকার দিনে বিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফাররা তাদের অ্যাসিস্ট্যান্টদের হাতে ধরে সবকিছু শেখাতেন। আমরা যেন ঠিক সেই সময়ে ফিরে গেছিলাম। ক্লাসে সেট সাজানো, লাইট গোডাউন থেকে বের করে আনা, লাইটের স্ট্যান্ড বসানো, লাইট করা, লাইট কাটা, ইলেকট্রিক কানেকশন করা, তড়পায় উঠে লাইট বসানো, ট্রলি লাইন পাতা, ট্রলি ঠেলা, ক্যামেরা করা থেকে শুরু করে ক্লাস শেষে সব আবার গুছিয়ে, গুটিয়ে জায়গা মত রাখা- সব স্যারের নির্দেশে আমরা ছাত্ররা করতাম। আমাদের সাহায্য করার জন্য অনেকে স্টুডিও ফ্লোরে থাকলেও স্যার তাদের বলতেন আমাদের নিজেদের করতে দিতে। সবকিছু হাতেকলমে করে, ঠিক হোক বা ভুল নিজেরা করে দেখতাম, শিখতাম, বুঝতাম। মানে, আমরা ছাত্ররাই একাধারে ‘আর্ট ডিরেক্টর’, ‘সেট ওয়র্কার’, ‘লাইট বয়’, ‘ইলেকট্রিশিয়ান’, ‘ট্রলি পুলার’, ‘ক্রেন অপারেটর’, ‘স্টেডিক্যাম অপারেটর’, ‘ক্যামেরা কেয়ারটেকার’, ‘ফোকাস পুলার’, ‘অ্যাসিস্ট্যান্ট সিনেমাটোগ্রাফার’ এবং ‘সিনেমাটোগ্রাফার’। এর ফলে শেখার মধ্যে একটা আনন্দ চলে এলো। যেন একটা স্বপ্নের জগৎ খুলে যেতে লাগলো।

 

এই অভ্যাসটা যে স্যার তখন তৈরি করে দিয়েছিলেন তার ফলে বুঝতে শিখি যে ‘সিনেমাটোগ্রাফি’ আর ‘ফিল্মমেকিং’ কী ভীষণ পরিমাণে ‘টিম ওয়র্ক’ আর এর সাথে জড়িত প্রতিটা মানুষের একটা সিনেমা তৈরি হওয়ার পিছনে কী বিশাল অবদান।

 

স্যার ‘লাইটিং’, ‘কম্পোজিশন’, ‘ক্যামেরা মুভমেন্ট’ ইত্যাদি আমাদের বিভিন্ন রকম করে দেখাতেন, সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা আমাদের বুঝিয়ে দিতেন ও আমাদের সেগুলো প্রথম প্রথম করে দেখাতে বলতেন। পরের দিকে উনি একজন পরিচালকের মত আমাদের বিভিন্ন সিচুয়েশন বলতেন ও সেটা নিয়ে আমরা প্রত্যেকে নিজেদের মত ভাবনা চিন্তা করে ‘ফ্রেম’, ‘লাইটিং’, ‘মুভমেন্ট’ নিজেরা করে সেটাকে ‘শুট’ করে স্যারকে দেখাতাম। উনি তারপর সেটা দেখে আমাদের বুঝিয়ে দিতেন কোথায় ভালো করেছি, কোথায় ভুল ত্রুটি, কোথায় আরো ভালো করা যায়। ক্লাসে উনি কোনো বিষয়ে নিজের মতো করে আমাদের দেখিয়ে দিলেও ওঁর মতামত বা ভাবনা চিন্তা আমাদের উপর কখনোই চাপিয়ে দিতেন না। বরং, স্যার আমাদের উৎসাহ দিতেন নতুন ভাবে কিছু করার, ভাবনা চিন্তা করার, এক্সপেরিমেন্ট করার, কাউকে অনুসরণ না করার।

 

স্যার যেভাবে স্টুডিও ফ্লোরে আমাদের প্রাকটিসে কোনো জটিল ক্যামেরা মুভমেন্টকে সহজে ভেঙে একই ‘ফিল’ এনে দিতেন বা প্রপার লাইট প্লেসমেন্ট দিয়ে, অল্প আলো ব্যবহার করে যেভাবে সহজে কোনো সিচুয়েশনের লাইটিং করে দেখাতেন, তার পিছনে স্যারের যে ভাবনা চিন্তাগুলো কাজ করত, সেগুলো আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করত।

 

স্যার ভীষণ খুশি হতেন যদি ওঁর করে দেখানো প্রসেসের বাইরে গিয়ে নতুন ভাবে কিছু করে দেখাতে পারতাম। এইভাবে আস্তে আস্তে স্যারের প্রতি ভয়টা কেটে গিয়ে একটা অসমবয়সী বন্ধুত্বের জায়গা তৈরি হয়ে গেল। স্যার যেভাবে আমাদের একদিকে ছাত্র এবং একই সাথে একজন ‘সিনেমাটোগ্রাফার’ হিসাবে জায়গা দিতেন, সম্মান দিতেন, প্রশ্রয় দিতেন এটা ভীষণ ভাবে আমাকে আকৃষ্ট করে। এইভাবে যেকোনো বিষয়ে স্যারের সাথে আলোচনা করার একটা জায়গা তৈরি হয়ে যায়। স্যার হিসাবে উনি কেমন ছিলেন, একটা কথা বললেই বোঝা যাবে। হয়তো কোনদিন স্যার নিজে একটা ‘সিচুয়েশান’ তৈরি করে আমাদের কিছু করে দেখালেন বা একটা নতুন রকম ভাবে ‘লাইট’ করা দেখালেন বা আমরা কিছু করেছি, উনি তার কারেকশন করে দিলেন। আমরা ক্লাস শেষে মহানন্দে বাড়ি গিয়ে পরের দিন ক্লাসে এলাম।

 

পরের দিন স্যার ‘রূপকলা’য় পা রেখে প্রথমেই বললেন স্টুডিও ফ্লোরে চল। কাল যেটা করে দেখিয়েছিলেন বা যেটা আমাদের ‘কারেকশন’ করে দিয়েছিলেন সেটা নিয়ে গতকাল রাতে উনি অনেক ভেবেছেন এবং ওঁর মনে হয়েছে কাল উনি 'ভুল করেছিলেন'। আজ উনি আগে সেটা ঠিক করবেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে, সিনেমাটোগ্রাফিতে এতকিছু অর্জন করার পরে, এত বছরের ফিল্মমেকিংয়ের অগাধ জ্ঞান নিয়েও যে মানুষ ক্লাসে আমাদের সামান্য প্রাক্টিস নিয়ে গোটা রাত ভাবতে পারেন ( স্বীকার করতে লজ্জা লাগে, আমরা নিজেরা কোনোদিন বাড়ি ফিরে অত ভাবিনি ) এবং নির্দ্বিধায় বলতে পারেন উনি কাল 'ভুল করেছিলেন' সেই মানুষ আমার আজীবনের শিক্ষক। আমি বড় ভাগ্যবান, এমন মানুষকে শিক্ষক পেয়েছি।


স্যার একটা অন্য সময়ের মানুষ হওয়া সত্বেও অত্যন্ত রকম আধুনিক-মনস্ক ছিলেন। ‘ফিল্মমেকিং’, ‘সিনেমাটোগ্রাফি’র আধুনিক সব ব্যাপারের খোঁজ খবর রাখতেন, নিয়মিত নতুন পুরনো সব রকমের সিনেমা দেখতেন। সিনেমা সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে নতুন নতুন ভাবনাচিন্তা করতে উনি যে  প্রশ্রয়টা আমাদের দিয়েছিলেন সেটা আমার নিজস্বতা তৈরি করতে ভীষণ সাহায্য করেছে। আমাদের বানানো প্রতিটা সিনেমা উনি খুঁটিয়ে দেখতেন, অ্যানালিসিস করে দিতেন, আমাদের থেকে জানতে চাইতেন আমরা কী ভাবছিলাম, কীভাবে করলাম। প্রশংসা করতেন, কোথাও ওঁর যদি মনে হত আরো ভালো করা যায় আমাদের ওঁর মতামত জানাতেন। স্যারের করা সিনেমাগুলো আমরা দেখে আলোচনা করলে তিনি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন। আমি ভীষণ সমৃদ্ধ হতাম এই আলোচনা গুলোতে।

 

নতুন কোনো সিনেমা দেখলে শুধুমাত্র সেটার ‘সিনেমাটোগ্রাফি’ না, গোটা সিনেমাটা নিয়েই স্যারের সাথে পরের দিন আলোচনা করতে মুখিয়ে থাকতাম। স্যার ভীষণ মন দিয়ে শুনতেন। মাঝে মাঝে বলতেন সিনেমাটা এনে দিতে যাতে স্যার ও সেটা দেখার সুযোগ পান। আদ্যোপান্ত সিনেমা-অন্ত প্রাণ মানুষ উনি।

 

ক্লাসের বাইরে স্যার ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। ভীষণ আমুদে, গল্প করতে ভালোবাসতেন, আমাদের মাঝে মাঝে ক্লাসে মিষ্টি, এটা-সেটা খাওয়াতেন। আমরা মাঝে মাঝে স্যারের বাড়ি যেতাম, গল্প করতাম অনেকক্ষন। স্যার ওঁর জীবনের অনেক মজার মজার গল্প বলতেন। শুটিং-এর গল্প শোনাতেন। আর একটা মজার কথা না বললেই নয়। আমার ভীষণ চায়ের নেশা। কিছুক্ষন অন্তর অন্তর আমি ক্লাসে স্যারের থেকে ৫ মিনিটের বাথরুম ব্রেক নিয়ে রূপকলার বাইরে চায়ের দোকান থেকে চা-টা নিয়ে খেতে খেতেই আবার ভিতরে চলে আসতাম, যাতে বেশি সময় নষ্ট না হয়। স্যার একদিন কোনো বন্ধুর থেকে জানতে পারেন আমি বাথরুম ব্রেক নিয়ে আসলে কী করি। তারপর থেকে স্যার নির্দেশ দিলেন, ক্লাসে যতবার স্যারের জন্য চা আসবে আমার এবং বাকি যারা চা খেতে চায় তাদের জন্যও চা আসবে। আমাদের কাউকে আর বাইরে যেতে হবে না। এই ট্র্যাডিশনটা এখনও আছে। এখন স্যার আর নেই। তবুও, এখনও ‘রূপকলা’ গেলে আমার সেই চা এখনও পাই। যতদিন স্যার বেঁচে ছিলেন, স্যারের বাড়ি গেলে চা না খাইয়ে স্যার ছাড়তেন না।

 

স্যার মারা যাওয়ার দু তিন সপ্তাহ আগে সৌরভ আর আমি স্যারের বাড়ি গিয়েছিলাম দেখা করতে। অনেকদিন স্যারকে দেখি নি। একদিন হঠাৎ সকালে উঠে মনে হল আজকেই স্যারকে দেখতে যাবো। সৌরভকে বললাম। ও সাথে সাথে রাজি। গেলাম দুজনে বিকেলে। স্যার নিজের আরামকেদারায় শুয়ে ছিলেন। আমরা যেতে আধবোজা চোখে একবার তাকালেন, তারপর আবার শুয়ে পড়লেন। শেষের দিকে স্যার আর কথা বলতে পারতেন না, খুব কম মানুষজনকে চিনতে পারতেন। আমরা দুই বন্ধু স্যারের দুই হাত নিজেদের হাতে নিয়ে আমাদের পুরোনো দিনের কথা, ‘রূপকলা’র কথা, ‘স্যারের ক্লাস’, বকুনি খাওয়া, স্যারের সাথে পুরোনো স্মৃতিগুলো নিয়ে কথা বলছিলাম। মনে হচ্ছিল স্যার যেন ঘুমিয়ে থেকেও আমাদের কথা শুনছেন। সেদিন স্যারকে দেখে খুব মায়া লেগেছিল। এটাই স্যারকে শেষ দেখা। তার কিছুদিন পরে স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমার ডেঙ্গু হওয়ায় শেষমেষ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। ফলে, স্যারের শেষদিনে আর যেতে পারিনি এটা আমার সারাজীবনের কষ্টের কারণ হয়ে থাকবে।

 

‘রূপকলা কেন্দ্র’ থেকে বেরিয়ে এখন ফ্রিল্যান্স সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করছি। তবে, বাইরের জগৎ বড় প্রফেশনাল জগৎ। এই জগতে রায় স্যারের মত শিক্ষক মেলে না। স্যারের ক্লাস, স্যারের সাথে সিনেমা নিয়ে আলোচনা, স্যারের কাছে ভুল গুলো বুঝে নেওয়া, ভুল গুলো ঠিক করে নেওয়া, স্যারের সাথে ক্লাসের পর আড্ডা এখন মিস করি। ‘রূপকলা কেন্দ্র’ মিস করি। স্যার এখন আর বেঁচে নেই। শেষের দিকে অনেক বছর স্যার শারীরিক কারণে আর রূপকলা কেন্দ্র আসতে পারতেন না। এখন আমার সেই ফিল্ম স্কুলে গেলে সবই ফিরে পাই, কিন্তু, স্যারের সেই রিভলভিং চেয়ারটা ফাঁকাই দেখি। স্টুডিও ফ্লোরে স্যারের সেই গমগমে গলা আর পাই না। স্যারের সাথে এক স্টুডিও ফ্লোরে ঘণ্টার পর ঘন্টা একসাথে কাজ করাটা মিস করি। রায় স্যারকে ক্লাসে ‘অ্যাসিস্ট’ করাটা মিস করি। আমার জীবনের একটা গোটা অধ্যায় আর আমার গোটা ভবিষ্যত রায় স্যারের সাথে জড়িয়ে আছে।